“দ্বি-চারিনী”
ফয়েজ আহমেদ।
রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় একটি পরিচিত নারী কন্ঠ ভেসে আসে সাকিলের কানে। কন্ঠটা রাস্তার পাশের ওই বাড়ীটা থেকে আসছে। বাড়ীটা সাকিলের পরিচিত। আব্দুল হকের বাড়ী। সাকিলের এক কাছের মানুষ ওই বাড়ীতে ভাড়া থাকত। নির্মান কাজের জন্য ভাড়াটিয়া বিদায় করেছেন,আব্দুল হক।
মাস তিনেক থেকে বাড়ীটা পরিত্যক্ত আছে। থমকে দাড়ায় সাকিল।নারী কন্ঠটা বোঝার চেষ্টা করে। ঠিকই ধরেছে সাকিল।কন্ঠটা তার পরিচিত। শুধু পরিচিত নয়। এই কন্ঠটা তার হৃদয়ের স্পন্ধের সাথে মিশে আছে। তার ভালবাসার প্রিয় মানুষের কন্ঠ। কিন্তু এই কন্ঠটা তালাবদ্ধ পরিত্যাক্ত ওই বাড়ী থেকে আসছে কেন। বুঝতে পারেনা সাকিল।
সাকিল আর কাজলীর সম্পকটা আজ দু’বছর আগের।সাকিল আর কাজল নিয়ম করে সপ্তাহে দু’তিন দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কাজলী বলেছে,সাকিলকে ছাড়া তার জীবন সে কল্পনা করতে পারেনা। সাকিলকে ছাড়া বাঁচবেনা কাজলী। সাকিলও কাজলকে অভয় দিয়েছে,তার জীবনে সে কাজলীকে ছাড়া অন্য কোন নারীর কথা ভাবতেও পারবেনা। কাজলী তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন।
সাকিল পুরো আশ্চর্য বনে গেছে। তার প্রানের প্রিয় কাজলী এই পরিত্যক্ত বাড়ীতে কেন। কার সাথে কথা বলছে কাজলী। বুঝতে পারেনা সাকিল। বদ্ধ ওই বাড়ীর ভিতর থেকে থেমে ভেসে আসছে,কাজলীর কোমল কন্ঠের আওয়াজ। কখনও খিল খিল ভেসে আসা কাজলীর হাসির শব্দ,সাকিলের হৃদয়ে তীরের মত বিদ্ধ হচ্ছে। কখনও কাজলীর কন্ঠের ফিসফিস শব্দ, সাকিলকে আহত করছে,মারাত্মক ভাবে। সাকিল ঘটনা ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করে।সাকিল বুঝতে পারে কাজলী একটা ছেলের সাথে একান্ত
অভিসারে লিপ্ত। রাগে ঘৃনায় জ্বলে যায়,সাকিলের অন্তর।
কলেজের একটা অনুষ্ঠানে কাজলীর সাথে পরিচয় হয় সাকিলের।পরে তাদের মধ্যে একটা ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কলেজ শেষে প্রত্যক দিন কাজলী আর সাকিল এক সাথে আড্ডা দেয়। আস্তে আস্তে দু’জন দু’জনের খুব কাছে আসে। ওদের মাঝে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভাল বন্ধু। কলেজ সহপাঠিরা কাজল আর সাকিলের এই বন্ধুত্বকে ভালবাসা সম্পর্ক মনে করে। তারা অন্যদের মাঝে এটা প্রচারও করে। কথাটা সাকিল আর কাজলীর কানেও এসেছে। কিন্তু ওরা অন্যর মনে করার ধার ধারেনা। ভাল বন্ধু হিসেবে এগিয়ে চলে সাকিল আর কাজলীর জীবন।
ভাল বন্ধু হিসেবে সাকিল আর কাজলের সম্পর্ক এগিয়ে চলছে। এরি মধ্যে আসে সেই মাহেন্দ্র ক্ষন। সাকিল আর কাজলীর প্রেমময় “মধুর জীবন” শুরুর পেক্ষাপট।কলেজের বার্ষিক বনভোজন। স্থান স্বপ্নপুরী। পিকনিকে কাজলী, সাকিলসহ ওদের সব বন্ধুরা অংশ নেয়। স্বপ্নপুরীতে দল করে ঘুড়ে বেরাচ্ছে ওরা সবাই।এমন সময় সাকিলের পরম বন্ধু শাওন,সাকিলকে কিছু বলার জন্য আড়ালে ডেকে নেয়।
শাওন বলে দোস্ত,আমি কাজলীকে অনেক দিন থেকে ভালবাসি। কিন্তু বলতে পারছিনা। প্লিজ আমার পক্ষে তুই কাজলীকে একটু বলনা।সাকিল কাজলীকে ভালবাসবে,এমন কল্পনা কখনও করেনি। পরম বন্ধু শাওনের এমন প্রস্তাবে, তাই অবাক হয়নি সাকিল।
বন্ধু শাওনের জন্য,কাজলীকে আলাদা করে ডেকে নেয় সাকিল। তিন জনে মিলে একটা ফুলের বাগানে বসে। এবার সাকিল কাজলীকে বলে,শাওন তোমাকে কিছু বলতে চায়। তুমি ওর সাথে কথা বল। কাজলী সাকিলকে বলে,ওনার সাথে আমার কোন কথা নেই। আপনি ডেকেছেন, তাই এসেছি। ওনার কোন কথা আমি শুনব না। সাকিল বুঝতে পারে,কাজলী শাওনকে পছন্দ করেনা।কাজলী কিছু একটা আচঁ করতে পেরে, চলে যেতে চায়।
কাজলীকে জোর করে বসায় সাকিল। সে কাজলীকে বলে,আমার বন্ধু শাওন তোমাকে খুব ভালবাসে। তুমি শাওনের ভালবাসা মেনে নাও। সাকিলের এমন কথার জবাবে কাজলী যে উত্তর দেয়,তা শুনতে প্রস্তত ছিলনা সাকিল। সে লজ্জা পেয়ে যায়। কাজলী সাকিলকে বলেছে,আমি যাকে ভালবাসি সে যদি অন্য কারো ভালবাসার প্রস্তাব করে, তাহলে কেমন লাগে।কাজলীর মুখে এমন কথা শুনে শাওন হতভম্ব হয়ে পড়ে। শাওন আর কোন কথা বলতে পারেনি।
পিকনিকের গাড়ী রাত দশ’টা নাগাদ ফিরেছে। কাজলীর বাড়ি অনেকটা দুরে।একটা গ্রামের ভিতরে।ওদের বাড়ী যাওয়ার রাস্তাটা ভালনা।রাতে ডাকাতি,ছিনতাই হয়। রাত আট’টার পরে ওই রাস্তায় কেউ যাতায়াত করেনা। সাকিল কাজলীকে বাড়ী পৌছে দিতে চায়। কাজলী বলে,আমি এত রাতে বাড়ীতে যাবনা। মাকে বলে এসেছি।বেশী রাত হলে,আপনাদের বাড়ীতে থাকব। কাজলীর বাড়ীর সবাই সাকিল কে চিনে, জানে। কাজলীর বাবা-মায়ের সাথে,সাকিলের খুব ভাল সম্পর্ক।
কাজলীকে নিয়ে বাড়ীতে আসে সাকিল। মাকে সব খুলে বলে। সাকিলের মা রেজওয়ানা বেগম সাকিলকে বারান্ধার চৌকিতে বিছানা করে দেয়। কাজলীকে সাকিলের ঘরে থাকতে বলে।রাতের খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।
প্রচন্ড শীতের রাত। কনকনে শীত। শীতে কাতর সাকিলের কিছুতেই ঘুম আসেনা। এমন সময় কাজলী ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসে। সাকিলের পাশে শুয়ে পড়ে। লজ্জায় লাল হয়ে যায় সাকিল। সে কাজলীকে বলে,তুমি আমার পাশে শুয়েছ কেন। বাড়ীতে বাবা-মা আছে।
কাজলী এবার শক্ত করে জরিয়ে ধরে সাকিলকে। মধু মিশ্রিত কন্ঠে বলে,আমার ভালবাসা কঠিন শীতে বারান্দায়,আর আমি থাকব ঘরে।এটা কিভাবে হয়। কাজলী আরো বলে,আপনি আমার সাথে ঘরে ঘুমাবেন। নইলে আমিও এখানেই থাকব,সারা রাত। সাকিল অনেক কষ্টে কাজলীকে তার শরীরের বন্ধন থেকে সরিয়ে ঘরে পাঠায়।
সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে সাকিলের। নাস্তা করে কাজলীকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। কাজলীদের বাড়ীতে আজ অনেক মেহমান। কাজলীর মা বলেছে না খেয়ে যেতে পারবেনা। কাজলীর ঘরে টিভি দেখছে সাকিল। পাশে বসে আছে কাজলী। হঠাৎ কাজলী সাকিলকে জড়িয়ে ধরে। বলে আই লাভ ইউ।
কোন উত্তর দেয়না সাকিল। সে ভাবে,তার বন্ধু শাওন কাজলীকে ভালবাসে। এদিকে কাজলী তাকে ভালবাসে। সে এখন কি করবে। সাকিল কাজলীকে বলে,অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমার বন্ধু তোমাকে ভালবাসে।আমি তোমাকে কি ভাবে গ্রহন করব।
কাজলী কোন কথা শুনবেনা। সে আজ সাকিলের কাছে ভালবাসি কথাটি শুনবেই। সে সাকিলকে বলে,তুমি আমাকে আই লাভ ইউ না বলা পর্যন্ত ছাড়বনা। জড়িয়ে ধরেই রাখব। ঘরের দরজাটা খোলা। যে কেউ যে কোন সময় ঘরে আসতে পারে। কি পাগলামী শুরু করল কাজলী। মানসম্মানের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে সাকিল। সে এবার কাজলীর ভালবাসার কাছে হার মানে।কাজলীকে আলতো করে ধরে,মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে বলে,আই লাভ ইউ।
কাজলী আর সাকিলের বন্ধুত্ব এখন গভীর প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। ওরা দু’জনে ঘর বাধার স্বপ্নে বিভোর। এদিকে বন্ধু শাওন সাকিলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। শাওন অন্যান্য বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়েছে,সাকিল তার ভালবাসা কাজলীকে ছিনিযে নিয়েছে। সাকিলকে দেখলে এড়িয়ে চলছে শাওন। সাকিল শাওনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে,কিন্তু শাওন বোঝেনি।
কাজলীকে নিয়ে বন্ধু শাওনের মধ্যেকার ভুলবুঝাবুঝি নিরসনে আরেক বন্ধু রাফি চেষ্টা করছে। বন্ধু রাফি তার বাড়ীতে শাওন আর সাকিলকে আসতে বলেছে। সাকিলকে সাথে করে কাজলীকে নিয়ে আসতে বলেছে। সাকিল আর কাজলী রাফির বাড়ীতে একটু আগেই এসেছে। এখনও আসেনি শাওন।
সাকিল আর কাজলী বন্ধু রাফির বাড়ীর একটি ঘরে বসে কথা বলছে। কাজলী হঠাৎ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়।সাকিলকে জড়িয়ে ধরে। আবেগের স্বরে বলে,আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবনা। কাঁদতে থাকে কাজলী। তার মনে কোন শংকা কাজ করে। সাকিল কাজলীকে সান্তনা দেয়। আমি শুধু তোমার।
বন্ধু রাফির বাড়ীতে এসেছে শাওন। সাথে আরেক বন্ধু সারোয়ার।কাজলী আর সাকিলকে ঘরে দরজা বন্ধ অবস্থায় দেখে শাওন চলে যায় । রাফি আটকানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। শাওন চলে যাওয়ায়,সাকিল আর কাজলীকে বিদায় দেয় রাফি।
সাকিল কাজলীকে নিয়ে ছোট খালার বাড়ীতে বেড়াতে যায়।খালার সাথে সাকিলের বন্ধুরমত সম্পর্ক। খালা একদিন কাজলীকে আনতে বলেছিল। কাজলীকে দেখবে।খালা কাজলীকে খুব পছন্দ করেছে। খালার বাসায় খাওয়া করে কাজলীকে বাড়ীতে পৌছে দেয় সাকিল।
সাকিল আর কাজলীর ভালবাসা,বিশ্বাস আর আস্থায় ভরপুর। ওরা দু’জন দু’জনকে খুব ভালবাসে। কলেজের সকল বন্ধু-বান্ধব সাকিল আর কাজলীর সম্পর্ক নিয়ে রসিকতা করে।
সাকিলের মাথা ঝিম ধরে আছে। কিছুই বুঝতে পারছেনা সাকিল। কাজলী কিভাবে এই নির্লজ্জ কাজটা করতে পারে। তার সাথে ভালবাসা সম্পর্ক বিদ্যমান। তাহলে আরেক’টা ছেলের সাথে কাজলী কিভাবে সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। সে কি দ্বি-চারিনী। সাকিল কি বুঝতে পারেনি,কাজলীকে। কাজলী কি আসলেই, এমন মেয়ে। হিসাব মেলেনা সাকিলের।
সাকিল রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছে। ও আজ আরো ভালভাবে সব কিছু দেখবে। কাজলীর আসল চরিত্র,উৎঘাটন করবে সাকিল। এইতো কাজলী বাড়ী থেকে বেড়োচ্ছে। সাথে ওই ছেলেটা। ছেলেটা বাড়ী থেকে বেড়িয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়।পরে কাজলীর হাত ধরে চলে যায়। নিজের চোঁখকে বিশ্বাস করতে পারেনা সাকিল। একটা মেয়ে এত খারাপ হতে পারে। সাকিল আর সহ্য করতে পারছেনা। এবার সে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়।
রাস্তায় কাজলীর সাথে দেখা হয় সাকিলের। এখন কাজলী একা। হয়ত ছেলেটা চলে গেছে।সাকিল না দেখার ভান করে যেতে থাকে। কাজলী ডাকে। ঘৃনায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাকিল। কিন্তু কিছু বলেনা। কাজলী সাকিলের সামনে এসে দাড়ায়। সাকিলকে বলে, আমাকে না দেখে এভাবে চলে যাচ্ছ কেন। সাকিল বলে,দেখতে পাইনি।কাজলী সাকিলের হাতটা ধরে। বলে চল, কোথাও বেড়িয়ে আসি।
সাকিল আর রাগ ধরে রাখতে পারেনা। সে কাজলীর বাম গালে কষে একটা থাপ্পর মারে। আশ্চর্য হয় কাজলী। সে সাকিলকে বলে,কি হয়েছে তোমার। সাকিল কোন উত্তর না দিয়ে কাজলীকে বলে, ধীক তারে শত ধীক,নির্লজ্জ যে জন। এর পর সাকিল সেখান থেকে দ্রুত চলে আসে।









