“নিষ্ঠুর করোনা”
ফয়েজ আহমেদ।
দু’চোঁখ দিয়ে নিরবে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। কিছুতেই থামাতে পারছেন না জোসনা বেগম। তার বুক চিড়ে বোবা কান্না বেড়িয়ে আসছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে। তাও পারছেন না। কারন এটাতো থানা। এখানে সে চিৎকার করে কাঁদতে পারেনা। তাই নিরবে চোঁখের পানি ঝড়াচ্ছে জোসনা বেগম।
জোসনা বেগমের স্বামী ওমর আলী সরকারী চাকুরী করেন। জোসনা বেগম ও ওমর আলী ভালবেসে বিয়ে করেছিল। ত্রিশ বছরের বৈবাহিক জীবনে তাদের এক ছেলে ও একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। জ্বামাই বিদেশে থাকেন। মেয়েটা তাদের কাছেই থাকে। জ্বামাই ছুটিতে আসলে মেয়েকে নিয়ে যায়। ছেলেটাও লেখাপড়া শেষ করে একটা বেসরকারী ফার্মে চাকুরী করছে। মোটা মাইনে পায়।
ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে খুবই ভাল কাটছিল জোসনা বেগমের জীবন। সুখের সংসার। এরই মধ্যে দেশে আর্বিভাব ঘটে করোনা ভাইরাস নামের এক মরন ব্যাধীর। এ ব্যাধীতে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। মারাও যাচ্ছে অনেকে। সরকার এ ভাইরাস দমনে অফিস-আদালতে সরকারী ছুটি ঘোষনা করেছে। দোকান-পাট,ব্যবসা-বানিজ্যে সব বন্ধ। বাড়িতেই কাটছে জোসনা বেগমের স্বামী ও সন্তানের অলস সময়। সবাই এক সাথে বাড়ীতে ভালই ছিল তারা।কিন্তু এ সুখ সইল না জোসনা বেগমের।
কয়েক দিন থেকে শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না জোসনা বেগমের। হঠাৎ তার জ্বর আসে। সাথে কাশি ও গলা ব্যাথা শুরু হয়। জোসনা বেগম তার সমস্যার কথা স্বামী ও ছেলে-মেয়েকে খুলে বলে। জোসনা বেগমের স্বামী একজন ডাক্তারকে ফোন করেছিল। কিন্তু ডাক্তার সাহেব জোসনা বেগমকে দেখতে অস্বীকৃতি জানায়। ছেলে আর মেয়েটাও তাদের পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করেছিল। কিন্তু কোন ডাক্তার জোসনা বেগমকে দেখতে রাজী হননি। তারা নাকি বলেছিল,জোসনা বেগমের করোনা হয়েছে।
থানায় পুলিশ জোসনা বেগমকে জিজ্ঞাসা করছে। তারা জানতে চাচ্ছে,আপনি জঙ্গলে কি ভাবে আসলেন। কারা আপনাকে হাত-পাঁ বেধে ফেলে গেছে। পুলিশের জেরার কোন জবাব দিতে পারছেনা জোসনা বেগম। সে কিভাবে বলবে,তার আদরের ছেলে-মেয়ে আর ভালবাসার স্বামী তাকে রাতের আধারে জঙ্গলে ফেলে গিয়েছে। পুলিশ আবারও জিজ্ঞেস করে বলুন,আপনি জঙ্গলে কিভাবে এলেন। কোন উত্তর দেয়না জোসনা বেগম। এ লজ্জার কথা কি ভাবে বলবে সে। না কিছুতেই তার স্বামী-সন্তানদের এ কুর্কীতির কথা বলতে পারবেনা জোসনা বেগম।
জোসনা বেগম ভেবে পায়না তার স্বামী ও সন্তানরা তাকে কিভাবে জঙ্গলে ফেলে দিল। রাতে জোসনা বেগমের জ্বর ও শ্বাষ কষ্টটা বেড়ে গিয়েছিল। জোসনা বেগমের স্বামী ও সন্তানরা কি যেন শলা-পরামর্শ করে। পরে জোসনা বেগমকে হসপিটালে নেওয়ার কথা বলে বাড়ীর গাড়ীতে তোলে। এর পর তারা বাড়ী থেকে অনেক দুরে একটা গহীন জঙ্গলে জোসনা বেগমকে হাত-পাঁ বেধে ফেলে যায়। স্বামী,ছেলে-মেয়েরা জোসনা বেগমকে ফেলে যাওয়ার সময় জোসনা বেগম কোন প্রতিক্রীয়া দেখাতে পারে নাই। সেই সময় জোসনা বেগমের শরীরে কোন শক্তি ছিলনা। সে জ্বরে ও শ্বাষ কষ্টে এতটা কাতর ছিল যে,তার শরীর কোন কাজই করছিল না।
নড়াচড়াও করতে পারেনি জোসনা বেগম। সে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে স্বামী-সন্তানদের নিষ্ঠুরতা। স্বামী-সন্তানকে সে বলতে শুনেছে রাতের মধ্যেই মারা যাবে সে। জোসনা বেগমের এ সময় কলিজা যেন ফেটে যাচ্ছিল। স্বামী-সন্তানদের এ অমানবিকতা কিছুতেই মানতে পারছিল না জোসনা বেগম। জোসনা বেগম ধরে নিয়েছিল এ গহীন অরন্যে রাতেই মারা যাবে সে। কিন্তু না। সে মরেনি। স্বামী-সন্তানরা চলে যাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যায় জোসনা বেগম। যখন তার জ্ঞান ফিরে, দেখতে পায় তার চার পাশে অনেক লোকজন আর পুলিশ ঘিরে আছে।
পুলিশ জোসনা বেগমকে গাড়ীতে করে থানায় নিয়ে এসেছে। আর এখন জানতে চাচ্ছে তার গহীন অরন্যে পড়ে থাকার ঘটনা। কারা তাকে ওখানে ফেলে গেছে,তাও জানতে চাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু কি ভাবে বলবে জোসনা বেগম। স্বামী-সন্তানদের ব্যাপারে কি বলা যায়। জোসনা বেগম ভাবতে থাকে। পরে সিদ্ধান্ত নেয়, সে পুলিশকে স্বামী-সন্তানদের ব্যাপারে কিছুই জানাবে না।
জোসনা বেগম পুলিশকে বলে,আমি রাত ন’টার দিকে ঔষধ নেওয়ার জন্য বাড়ীর পাশের দোকানে গিয়েছিলাম। কারা যেন আমাকে ধরে একটা গাড়ীতে তুলে ওই জঙ্গলে ফেলে চলে যায়। আমার হাত-পাঁ বাধা থাকায় আমি ওখানে অজ্ঞান হয়ে যাই। পুলিশ জোসনা বেগমের স্বামী-সন্তান ও বাড়ীর ঠিকানা জানতে চায়। জোসনা বেগম পুলিশকে মিথ্যা কথা বলে। সে পুলিশকে জানায় তার কোন স্বামী-সন্তান নেই। সে বাপের বাড়ীতে থাকে। পুলিশ থানার গাড়ীতে করে জোসনা বেগমকে তার বাপের বাড়ীতে পৌছে দেয়।
জোসনা বেগমের বাবা আলী মুদ্দিন রিটায়ার্ড সেনা সদস্য। বয়স ৮০ হলেও এখনও টান টান শরীর। মা বেঁচে নেই। পাঁচ বছর হল তিনি গত হয়েছেন। ভাই খোকন ব্যাবসা করেন। পুলিশের গাড়ী জোসনা বেগমকে বাপের বাড়ীতে রেখে যাওয়ায় আশ্চর্য বনে যান জোসনা বেগমের বাবা ও ভাই তারিক আহমেদ। তারা ঘটনা কি বুঝতে পারেননা। পুলিশ চলে যাওয়ার পর তারা ঘটনার ব্যাপারে জানতে চান। জোসনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বাবা-ভাইকে সব ঘটনা খুলে বলেন। জোসনার বাবা-ভাই জোসনা বেগমকে স্বান্তনা দেন। তারা জোসনা বেগমের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেন।
আজ জোসনা বেগমের করোনা টেষ্টের রেজাল্ট বেড়িয়েছে। সে করোনা নেগেটিব। সাধারন জ্বর-কাশি ও শ্বাষ কষ্ট হয়েছিল জোসনা বেগমের। এখন সে সম্পুন্ন সুস্থ্য। জোসনা বেগমের স্বামী-সন্তানরাও খবরটা জেনেছে। কিন্তু তারা জোসনা বেগমকে নিতে আসেনি। জোসনা বেগমও সিদ্ধান্ত নেয়, যে স্বামী ও সন্তানরা তাকে রাতের আধারে জঙ্গলে হাত-পাঁ বেধে ফেলে গেছে,তাদের কাছে সে কখনোই ফিরবেনা। জোসনা বেগমের কেন জানি মনে হয়, এই করোনাই তার স্বামী-সন্তানদের এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক মানুষে পরিনত করেছে। সে এই নিষ্ঠুর করোনাকে পৃথিবী থেকে তুলে নেয়ার জন্য মহান আল্লাহ’র কাছে ফরিয়াদ জানান।









